জেলে বসেই হুইস্কি-সোডা, মুরগি-মটন
অমিত চক্রবর্তী
রেস্ত থাকলে জেলের ভাতেও ঘি পড়ে!
'ধুর'৷ অর্থাত্, শাঁসালো পার্টি৷ আর এদের ঘিরেই রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে রীতিমতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলছে সমান্তরাল বাণিজ্য-শৃঙ্খল৷ যেখানে অংশীদার সবাই, মুনাফার ভাগও জোটে সকলের বরাতে৷
বিরিয়ানি চাই? কিং সাইজ সিগারেট? বা, নামী ব্র্যান্ডের হুইস্কি? গাঁজা, হেরোইন? সব মিলবে জেলের কুঠুরিতে৷ সৌজন্যে 'ইনচার্জ' আর 'রাইটার'৷ দুই থেকে তিন মাসের জন্য নিলামে এ দু'টি পদ বিলি হয় জেলের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে৷ 'ইনচার্জ' বা 'রাইটার' পদ দু'টি সরকারি ভাবে স্বীকৃত৷ যে সব সাজাপ্রাপ্ত বন্দির রেকর্ড ভালো, তাদেরই এই পদ পাওয়ার কথা৷ অথচ, আইনের তোয়াক্কা না-করে, নিলাম ডেকে তা দেদার বিলি হচ্ছে৷ বাইরে যারা তোলাবাজি, অপহরণ বা খুনে সিদ্ধহস্ত, হাজতে সেই দাগিরাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দখল করছে পদ দু'টি৷ নেপথ্যে, মোটা টাকার রফা আর পেশিশক্তির আস্ফালন৷ এই পুরো ব্যবস্থায় জড়িত জেলের আধিকারিক থেকে শুরু করে গেটের সেপাই পর্যন্ত৷
নিলাম ঘিরে এত উত্সাহ কেন? নিলামে ওঠা টাকা যেমন অফিসার থেকে আরদালিরা ভাগ করে নেন, তেমনই যারা নিলামে ইনচার্জ বা রাইটার হচ্ছে, তারাও দু'-তিন মাসের 'শাসনকালে' মোটা মুনাফা তুলে নেয়৷ আর এ ক্ষেত্রেই 'ধুর'দের গুরুত্ব বাড়ে৷ যার আওতায় যত বেশি 'ধুর', তার লক্ষ্মীলাভ তত বেশি৷
মাহেশ্বরী বা ভুজিয়াওয়ালারা শ্রীঘরে ঢুকলে ইনচার্জ, রাইটারদের পোয়াবারো৷ এমন 'ধুরে'র প্রত্যাশী হয়েই তো নিলাম ডাকার ঝুঁকি নেওয়া! হিটারে আলাদা রান্না করে তাঁদের সপ্তাহে দু'দিন মাছ, তিন দিন মাংস বা পনির মশালা সার্ভ করতে তত্পর ইনচার্জরা৷ প্রায় বিশ বছর আগে 'জেল' যখন 'সংশোধনাগার' হয়েছিল, তখন সরকারি ভাবে ইনচার্জদের দায়িত্বে ছিল বন্দিদের খাবারের দেখভাল, অসুস্থ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থার মতো কাজ৷ আর রাইটারের মূল দায়িত্ব ছিল বন্দিদের হয়ে চিঠি লেখা, দিনের শেষে বন্দি-সংখ্যা মেলানো৷ এখনও অবশ্য তাঁরা মেলান, তবে অন্য হিসেব৷ এক বন্দির আইনজীবীর কথায়, 'ওদের পয়সা দিলে, জেলে মোবাইল ব্যবহার তো কোন ছার, ল্যাপটপ পর্যন্ত আনিয়ে দেবে সেলে৷' একদিকে 'রহিস' আর অন্য দিকে 'ছাপোষা' বন্দিদের নিয়ে রমরমিয়ে চলছে বাণিজ্য-শৃঙ্খল৷
মুদ্রার অবশ্য উল্টো পিঠও আছে৷ 'পেটি কেসে'র আসামি, যাদের মেরে ফেললেও 'পকেট কাটিং' (অর্থাত্ আয়) হবে না, তারা হয়ে যায় 'ভল্যান্টিয়ার'৷ ইনচার্জ আর রাইটারের কথামতো ফাই-ফরমাশ খাটা, 'ধুর'দের রান্না করা, কাপড় কাচা বরাদ্দ তাদের জন্য৷ আবার 'ধুর'রা বাড়াবাড়ি করলে, তাদের জন্য বরাদ্দ শৌচাগার পরিষ্কার, ঝাড়ু দেওয়ার মতো কাজ৷ প্রয়োজনে চড়-চাপাটি তো আছেই৷
ইনচার্জ বা রাইটার পদের নিলাম এবং 'ধুর'দের থেকে প্রাপ্ত টাকার বখরা কর্তারা কে কত পাবেন, তা নির্ধারিত হয় জেলের 'স্টেটাস' বুঝে৷ বড় জেল, বেশি বখরা কর্তাদের৷ যেমন, আলিপুর বা প্রেসিডেন্সি জেলে এখন প্রতিটি 'ফাইলে'র (জেলের একটি ফাইলে ৭০ থেকে ১৫০জন বিচারাধীন বন্দিকে রাখা হয়) জন্য তিন মাসের নিলামের রেট চলছে ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ আগেভাগেই 'ধুর' রয়েছে, এমন ফাইলের নিলাম-দর অবশ্যই একটু চড়া৷ নিলাম ডাকার টাকা ভাগ করে দেবে ইনচার্জ ও রাইটার৷ নিলামে প্রাপ্ত টাকার ভাগ জোটে কর্তা থেকে জমাদার, সকলের বরাতে৷ নিলামের পর ফাইলে তেমন বড় কোনও 'ধুর' এলে, তার জন্য উপরি তো আছেই৷ আবার 'ধুর' হাতানোর জন্য চলে কর্তাদের তদ্বির, প্রয়োজনে সেলামি দেওয়ার রেওয়াজও আছে৷ রাজ্যের বড় জেলগুলিতে ২০-২২টি করে 'ফাইল' আছে৷ প্রতিটির জন্য ইনচার্জ এবং রাইটার পদের আলাদা নিলাম হয়৷ অর্থাত্, স্রেফ নিলাম থেকেই কর্তাদের পকেট কতটা ভারী হচ্ছে, অনুমান করা কঠিন নয়৷
বন্দিদের টাকা জেলে ঢোকানোর ক্ষেত্রে রয়েছে অলিখিত চুক্তি৷ বড়সড় 'ধুর'কে চমকে-ধমকে দু'-তিন পেটি (লাখ) 'কাটিংয়ে'র ব্যবস্থা হলে তা বাড়ির লোক নিয়ে আসতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে সেপাইকে শ'তিনেক টাকা দিয়ে নিতে হবে 'গেট-পাস'৷ রয়েছে 'হোম ডেলিভারি'র ব্যবস্থাও৷ 'মাড়োয়ারি' (জেলে পয়সাওয়ালাদের এ নামেই পরিচয়) পার্টিদের পেটি আনতে জমাদার বা কোনও সেপাই গিয়ে বাড়ির কলিংবেল বাজাবেন৷ আগেভাগে অবশ্য তাঁদের যাওয়ার খবর চলে আসবে মোবাইল বেয়ে৷ সেই 'দূত' টাকার ব্যাগ জেলে এনে নিজের কমিশন (গড়ে ২০ শতাংশ) সরিয়ে রেখে বাকিটা পৌঁছে দেবেন ফাইলে৷
গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে নিলাম হেঁকে পাওয়া পদ! তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর ইনচার্জ এবং রাইটারদের প্রথম কাজই হয় 'ধুর' খোঁজা৷ 'ধুর' না-পেলে পুরোটাই লোকসান৷ তাই কখনও জেলকর্তাদের চাপ দিয়ে, কখনও মিষ্টি কথায় নতুন 'ধুর'দের নিজেদের ফাইলে টানতে কসুর করে না ইনচার্জ বা রাইটাররা৷ মাস তিনেকে নিলামের খরচ তো উঠে আসেই, মুনাফা কখনও বিনিয়োগের দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়৷
কারা বিভাগের আইজি রণবীর কুমার অবশ্য বলছেন, 'সরকারি ভাবেই বিচারাধীন বন্দিদের সুবিধার জন্য ইনচার্জ এবং রাইটার পদ রয়েছে৷ কারা ওই পদের যোগ্য দাবিদার, তা দেখার কথা জেল সুপারদের৷ তবে ওই সব পদ নিয়ে কোনও বেআইনি কিছু হচ্ছে বলে অভিযোগ পাইনি৷' প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগটা করবেন কে? এক আইনজীবীর মোক্ষম প্রশ্ন, 'আরে দাদা, ঘুষের আবার রসিদ হয় নাকি?'
রেস্ত থাকলে জেলের ভাতেও ঘি পড়ে!
'ধুর'৷ অর্থাত্, শাঁসালো পার্টি৷ আর এদের ঘিরেই রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে রীতিমতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলছে সমান্তরাল বাণিজ্য-শৃঙ্খল৷ যেখানে অংশীদার সবাই, মুনাফার ভাগও জোটে সকলের বরাতে৷
বিরিয়ানি চাই? কিং সাইজ সিগারেট? বা, নামী ব্র্যান্ডের হুইস্কি? গাঁজা, হেরোইন? সব মিলবে জেলের কুঠুরিতে৷ সৌজন্যে 'ইনচার্জ' আর 'রাইটার'৷ দুই থেকে তিন মাসের জন্য নিলামে এ দু'টি পদ বিলি হয় জেলের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে৷ 'ইনচার্জ' বা 'রাইটার' পদ দু'টি সরকারি ভাবে স্বীকৃত৷ যে সব সাজাপ্রাপ্ত বন্দির রেকর্ড ভালো, তাদেরই এই পদ পাওয়ার কথা৷ অথচ, আইনের তোয়াক্কা না-করে, নিলাম ডেকে তা দেদার বিলি হচ্ছে৷ বাইরে যারা তোলাবাজি, অপহরণ বা খুনে সিদ্ধহস্ত, হাজতে সেই দাগিরাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দখল করছে পদ দু'টি৷ নেপথ্যে, মোটা টাকার রফা আর পেশিশক্তির আস্ফালন৷ এই পুরো ব্যবস্থায় জড়িত জেলের আধিকারিক থেকে শুরু করে গেটের সেপাই পর্যন্ত৷
নিলাম ঘিরে এত উত্সাহ কেন? নিলামে ওঠা টাকা যেমন অফিসার থেকে আরদালিরা ভাগ করে নেন, তেমনই যারা নিলামে ইনচার্জ বা রাইটার হচ্ছে, তারাও দু'-তিন মাসের 'শাসনকালে' মোটা মুনাফা তুলে নেয়৷ আর এ ক্ষেত্রেই 'ধুর'দের গুরুত্ব বাড়ে৷ যার আওতায় যত বেশি 'ধুর', তার লক্ষ্মীলাভ তত বেশি৷
মাহেশ্বরী বা ভুজিয়াওয়ালারা শ্রীঘরে ঢুকলে ইনচার্জ, রাইটারদের পোয়াবারো৷ এমন 'ধুরে'র প্রত্যাশী হয়েই তো নিলাম ডাকার ঝুঁকি নেওয়া! হিটারে আলাদা রান্না করে তাঁদের সপ্তাহে দু'দিন মাছ, তিন দিন মাংস বা পনির মশালা সার্ভ করতে তত্পর ইনচার্জরা৷ প্রায় বিশ বছর আগে 'জেল' যখন 'সংশোধনাগার' হয়েছিল, তখন সরকারি ভাবে ইনচার্জদের দায়িত্বে ছিল বন্দিদের খাবারের দেখভাল, অসুস্থ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থার মতো কাজ৷ আর রাইটারের মূল দায়িত্ব ছিল বন্দিদের হয়ে চিঠি লেখা, দিনের শেষে বন্দি-সংখ্যা মেলানো৷ এখনও অবশ্য তাঁরা মেলান, তবে অন্য হিসেব৷ এক বন্দির আইনজীবীর কথায়, 'ওদের পয়সা দিলে, জেলে মোবাইল ব্যবহার তো কোন ছার, ল্যাপটপ পর্যন্ত আনিয়ে দেবে সেলে৷' একদিকে 'রহিস' আর অন্য দিকে 'ছাপোষা' বন্দিদের নিয়ে রমরমিয়ে চলছে বাণিজ্য-শৃঙ্খল৷
মুদ্রার অবশ্য উল্টো পিঠও আছে৷ 'পেটি কেসে'র আসামি, যাদের মেরে ফেললেও 'পকেট কাটিং' (অর্থাত্ আয়) হবে না, তারা হয়ে যায় 'ভল্যান্টিয়ার'৷ ইনচার্জ আর রাইটারের কথামতো ফাই-ফরমাশ খাটা, 'ধুর'দের রান্না করা, কাপড় কাচা বরাদ্দ তাদের জন্য৷ আবার 'ধুর'রা বাড়াবাড়ি করলে, তাদের জন্য বরাদ্দ শৌচাগার পরিষ্কার, ঝাড়ু দেওয়ার মতো কাজ৷ প্রয়োজনে চড়-চাপাটি তো আছেই৷
ইনচার্জ বা রাইটার পদের নিলাম এবং 'ধুর'দের থেকে প্রাপ্ত টাকার বখরা কর্তারা কে কত পাবেন, তা নির্ধারিত হয় জেলের 'স্টেটাস' বুঝে৷ বড় জেল, বেশি বখরা কর্তাদের৷ যেমন, আলিপুর বা প্রেসিডেন্সি জেলে এখন প্রতিটি 'ফাইলে'র (জেলের একটি ফাইলে ৭০ থেকে ১৫০জন বিচারাধীন বন্দিকে রাখা হয়) জন্য তিন মাসের নিলামের রেট চলছে ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ আগেভাগেই 'ধুর' রয়েছে, এমন ফাইলের নিলাম-দর অবশ্যই একটু চড়া৷ নিলাম ডাকার টাকা ভাগ করে দেবে ইনচার্জ ও রাইটার৷ নিলামে প্রাপ্ত টাকার ভাগ জোটে কর্তা থেকে জমাদার, সকলের বরাতে৷ নিলামের পর ফাইলে তেমন বড় কোনও 'ধুর' এলে, তার জন্য উপরি তো আছেই৷ আবার 'ধুর' হাতানোর জন্য চলে কর্তাদের তদ্বির, প্রয়োজনে সেলামি দেওয়ার রেওয়াজও আছে৷ রাজ্যের বড় জেলগুলিতে ২০-২২টি করে 'ফাইল' আছে৷ প্রতিটির জন্য ইনচার্জ এবং রাইটার পদের আলাদা নিলাম হয়৷ অর্থাত্, স্রেফ নিলাম থেকেই কর্তাদের পকেট কতটা ভারী হচ্ছে, অনুমান করা কঠিন নয়৷
বন্দিদের টাকা জেলে ঢোকানোর ক্ষেত্রে রয়েছে অলিখিত চুক্তি৷ বড়সড় 'ধুর'কে চমকে-ধমকে দু'-তিন পেটি (লাখ) 'কাটিংয়ে'র ব্যবস্থা হলে তা বাড়ির লোক নিয়ে আসতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে সেপাইকে শ'তিনেক টাকা দিয়ে নিতে হবে 'গেট-পাস'৷ রয়েছে 'হোম ডেলিভারি'র ব্যবস্থাও৷ 'মাড়োয়ারি' (জেলে পয়সাওয়ালাদের এ নামেই পরিচয়) পার্টিদের পেটি আনতে জমাদার বা কোনও সেপাই গিয়ে বাড়ির কলিংবেল বাজাবেন৷ আগেভাগে অবশ্য তাঁদের যাওয়ার খবর চলে আসবে মোবাইল বেয়ে৷ সেই 'দূত' টাকার ব্যাগ জেলে এনে নিজের কমিশন (গড়ে ২০ শতাংশ) সরিয়ে রেখে বাকিটা পৌঁছে দেবেন ফাইলে৷
গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে নিলাম হেঁকে পাওয়া পদ! তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর ইনচার্জ এবং রাইটারদের প্রথম কাজই হয় 'ধুর' খোঁজা৷ 'ধুর' না-পেলে পুরোটাই লোকসান৷ তাই কখনও জেলকর্তাদের চাপ দিয়ে, কখনও মিষ্টি কথায় নতুন 'ধুর'দের নিজেদের ফাইলে টানতে কসুর করে না ইনচার্জ বা রাইটাররা৷ মাস তিনেকে নিলামের খরচ তো উঠে আসেই, মুনাফা কখনও বিনিয়োগের দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়৷
কারা বিভাগের আইজি রণবীর কুমার অবশ্য বলছেন, 'সরকারি ভাবেই বিচারাধীন বন্দিদের সুবিধার জন্য ইনচার্জ এবং রাইটার পদ রয়েছে৷ কারা ওই পদের যোগ্য দাবিদার, তা দেখার কথা জেল সুপারদের৷ তবে ওই সব পদ নিয়ে কোনও বেআইনি কিছু হচ্ছে বলে অভিযোগ পাইনি৷' প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগটা করবেন কে? এক আইনজীবীর মোক্ষম প্রশ্ন, 'আরে দাদা, ঘুষের আবার রসিদ হয় নাকি?'
No comments:
Post a Comment