Friday, November 7, 2014

কোচির ঘটনা প্রসঙ্গে

কোচির ঘটনা প্রসঙ্গে
গত ৫ই নভেম্বর কোচিতে একটি ক্যাফেতেঢুকে ভাঙচুরচালালোসংঘ পরিবারের যুব মোর্চা—অভিযোগ ওই ক্যাফেতেবসে নাকি প্রেমিক-প্রেমিকারা 'ডেটিং' করে। এর বিরুদ্ধে কোচিতে বহু যুবক-যুবতীএকত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে ভালবাসা জ্ঞাপন করে প্রতিবাদ করতে চাইলেপুলিশমারধোর করে তাদের।গোটাদেশেরনানাপ্রান্তের ছাত্র-যুবরা এই ঘটনার প্রতিবাদে কোচির 'কিস অফ লাভ'-নামে চালু হতে থাকা প্রতিবাদের পক্ষে জড়ো হতে থাকে। মুম্বাই, কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, দিল্লী এরকম নানাশহরে ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রতিবাদ।একইসঙ্গে মিডিয়া ও সোস্যালনেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকলে আন্দোলনের এইফর্মনিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মেরুকরণঘটতে থাকে সমাজের মধ্যে এমনকি সংগ্রামী ব্যাক্তিসমূহ তথা সংগঠনদের মধ্যেও।
প্রথমত: এটা মাথায় রাখার দরকার 'সংঘ' শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রকাশ্যে প্রেম করার বিরুদ্ধে নামেনি, ওরা নেমেছে প্রেম করার-ই বিরোধিতা করতে।সাম্প্রতিককালেকোচির ক্যাফেতেগিয়ে ভাঙচুর কিংবা মহারাষ্ট্রের আহমদনগরে উচ্চবর্ণের মেয়ের সাথে প্রেম করার ফলে দলিত পরিবারের বাবা-মা-ছেলেকে কুচিয়েকেটে হত্যা করার ঘটনা হোককিংবাব্যাঙ্গালোরের 'পাব'-এ গিয়ে কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মারধোর, মুম্বাই-এ বিভিন্ন সময়ে পার্কে একসাথে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের কান ধরে ওঠবোসকরানো—ব্যক্তিগত জীবনে এই হস্তক্ষেপ সংঘ পরিবার করতেই থাকে কখনো শ্রীরাম সেনা, কখনো বজরং দল কখনো যুব-মোর্চা এরকম নানানামে।প্রথম প্রশ্নটা হলকে-কোথায়-কখন-কিভাবে প্রেম-বন্ধুত্ব করবে সেটা কী সংঘ পরিবার ঠিক করবে? দেশজুড়ে ওরা নেমেছে 'লাভ-জিহাদ'-এর নামে অন্য জাতের-ধর্মের মানুষকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে, 'লিভ-টুগেদার' এর বিরুদ্ধে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধরণেরমধ্যে নাক গলাতে। আসলে ওদের বিরোধিতা হল দেশের মেয়েরা তাদের নিজেদের ইচ্ছায় সম্পর্ক-বন্ধুত্ব করা নিয়ে, কারণ ওরা চায় মেয়েদের শরীর ও যৌনতার ওপর পরিবারের-সমাজের-সংঘেরদখলদারি।
উচ্চবর্ণেরমারাঠী পুরুষদের সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা আর.এস.এসপ্রথম থেকেই জাতিবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী।কেরালায়নাম্বুদ্রিব্রাম্ভণরা একসময় অন্য যেকোনো সম্প্রদায়ের মেয়েদের প্রথম সন্তান কোনো নাম্বুদ্রিব্রাম্ভণেরসাথেই হতে হবে এই নিয়ম লাগু করে কার্যত ধর্ষণ করতো অন্য সম্প্রদায়ের মেয়েদের।আর.এস.এস এর সবচেয়ে পূজনীয় নেতা গোলওয়ালকর এর মত ছিল যে-নিচু জাতের মানুষদের 'উন্নত' করতে গেলে তাদের সাথে এরকমই করতে হবে,যেরকম'ক্রস-ব্রিডিং' করা হয় জন্তুজানোয়ারদের ক্ষেত্রে।জন্মলগ্ন থেকেই সংঘ 'ভারতীয় সংস্কৃতি'র নাম করে মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখার পক্ষে, মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়ার বিরোধীওরা, বিরোধী বিধবাদের পুনর্বিবাহ করার, মেয়েদের পোশাক নিয়ে ওরানানাসময়জারি করতে থাকে ফরমান, এমনকি আজ পর্যন্ত আর.এস.এস সংগঠনের সদস্য হতে পারেনা কোনো মেয়ে।গোটা সমাজজুড়ে যখন কথা উঠছে মেয়েদের সমানাধিকার নিয়ে, মেয়েদের শরীরের ওপর পরিবার ও পুরুষদের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে, জাতপাতেরনামে মানুষকে শোষণযখনসমাজেখারাপ কাজ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে তখন সংঘ নতুন করে আক্রমণাত্মকহচ্ছে মেয়েদের বিরুদ্ধে আর নিচু জাতির মানুষদের নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য, প্রান্তিকলিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের বিরুদ্ধে।
মিডিয়ার দৌলতে এখন কোচির ক্যাফেতেগিয়ে ভাঙচুর করে যে জঘন্য গুন্ডামি করেছে আরএসএস তার থেকে বেশি সামনে আসছে তার প্রতিবাদে 'চুমু খাওয়ার' ঘটনা। কিন্তু,কেউ যদি প্রতিবাদের কোনো একটি বিশেষ ফর্মেরসাথে একমত না-ও হন, তাহলেও তো প্রতিবাদের অন্তর্বস্তুরকারণেই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভূমিকাপালন করাটা রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।ভারতবর্ষে আর.এস.এস একটি ফ্যাসিস্ত শক্তি যারা আজ পুঁজিপতিদের সাথে হাত মিলিয়ে শাসনক্ষমতা চালাচ্ছে বিজেপিকে সামনে রেখে। শুধু তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখে কিংবা আলোচনার মাধ্যমে এরা নিজেদের বক্তব্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপেক্ষা করেনিকখনো—এরা গায়ের জোর খাটিয়েছে, খুন-জখম-বিস্ফোরণ ঘটানো-দাঙ্গালাগানোর এই ট্রাডিশন চলছে গান্ধী হত্যা থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকরা, গুজরাট দাঙ্গা থেকে আজ পর্যন্ত।এদের প্রতিরোধ করার জন্য সর্বাত্মক লড়াই গড়ে তুলতে না পারলে আগামী দিন আরো ভয়ঙ্কর হবে। প্রবল অবদমনের পরিবেশের মধ্যে দেশের নানা অংশের মানুষ যখন দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে বেড়িয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথে নামবেন, তখন সেই প্রতিবাদের সমস্ত রূপগুলির সাথে হয়তো একমত হতে পারবেন না সমস্ত প্রতিবাদী মানুষ, কারণ তারা সকলে মিলেএকসাথেএগুলি তৈরী করবেন না।
পৃথিবীতে আন্দোলনের যে ফর্মগুলো আজকে স্বীকৃতি পেয়েছে সেগুলো উঠে এসেছে মানুষের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই। সে মিছিল হোক কিংবাঘেরাও, স্লোগান কিংবা দেওয়াল লেখা, পথ অবরোধ-পিকেটিং-ধর্মঘট কিংবা ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাস-ট্রাম জ্বালানো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কোনো কোনোফর্ম হারাচ্ছে প্রাসঙ্গিকতাআবার প্রতিদিন তৈরীও হচ্ছে নতুন নানাকিছু।যুগ যুগধরে আন্দোলনের ফর্ম কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলেনি, আর সবসময় সংগঠিত বাম আন্দোলনের মধ্যে থেকেও বিকশিত হয়নি।আসামরাইফেলস-এর বিরুদ্ধে মণিপুরী মহিলারা যখন প্রকাশ্যে নগ্ন হয়ে জানিয়েছিলেন 'Indian Army Rape Us'তখন দীর্ঘদিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের যন্ত্রনার অভিব্যক্তির তীব্রতার সামনে দাঁড়াতে পারেনি কোনো হাসি-টিপ্পনি-'কিন্তু-পরন্তু'।তিউনিশিয়া-তেলেঙ্গানা সহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে মানুষ যখন শত্রুপক্ষের বিরাট শক্তির সামনেপ্রতিবাদের রাস্তা হিসেবে বেছে নেয় নিজেদেরগায়ে আগুন লাগানো, কারখানায় দিনের পর দিন মধ্যযুগীয় অত্যাচার সহ্য করতে করতে ভারতের জুটমিল কিংবা গার্মেন্ট শ্রমিকরা যখন বিক্ষোভে ফেটেপড়েপুড়িয়ে মারে কারখানা মালিককে, চৌরীচৌরাতে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা অহিংস আন্দোলনের বদলেআক্রমণের মুখে প্রতিআক্রমণ করে বসে তখন আন্দোলন ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া কিন্তু ক্ষতি করে বৃহত্তর লড়াইটার-ই।
আমাদের দেশে নারীমুক্তি ও লিঙ্গসচেতনতার প্রশ্নে সমাজে বিপুল পশ্চাদপদতা আছে, যার বিরুদ্ধে লড়াই এদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর তাই এদেশে রাস্তায় প্রকাশ্যে ঘুষ খেলে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, প্রকাশ্য রাস্তায় পুরুষরা প্রস্রাব করলে তাতে সমাজ রে-রে করে আসে না, কিন্তু প্রকাশ্যে ভালবাসা বিনিময় গোটা সমাজে নাড়াচাড়া ফেলে দেয়। যে সমাজে প্রেম ও যৌনতার প্রশ্ন প্রবল অবদমনের মধ্যে রয়েছে, সমাজ-রাষ্ট্র যেখানে সর্বদা ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করে চলেছে আর আজকের দিনে যখন এই অবদমন তার সর্বোচ্চ সংগঠিত ও হিংস্র রূপ নিচ্ছে সংঘ পরিবারের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে সেই পরিপ্রেক্ষিতে,আক্রমণের প্রতিক্রিয়াতে গড়ে ওঠা 'প্রকাশ্যে ভালবাসা'র কোনো একটা ফর্ম একটা 'পলিটিক্যাল এক্ট' হয়ে উঠতে পারে। যেমন, যেখানে কারো একমুখ দাড়ি থাকলেই তাকে আতঙ্কবাদী হিসেবে সন্দেহ করা হয় ও অত্যাচার করা হয় সেখানে দাড়ি রাখাটা হয়ে উঠতে পারে একটা 'পলিটিক্যাল এক্ট'। যেখানে মেয়েদের বোরখা ছাড়া রাস্তায়বেরুনোর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা আছে, সেখানে একটি মেয়ের বোরখা খুলে সর্বসমক্ষে মুখ দেখানোটাই হয়ে উঠতে পারে একটা প্রতিস্পর্দ্ধীভূমিকা।
কোচির ঘটনায় প্রতিবাদের এই ফর্ম কিন্তু একটা শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, সংঘের গুন্ডামির ঘটনাটাকে গোটা দেশের মানুষের সামনে এনে উপস্থিত করেছে। সমাজের বিদ্যমান পশ্চাদপদতাকে কাজে লাগিয়ে সংঘ যদি তার মধ্যযুগীয় কারবার চালিয়ে যেতে থাকে তাহলে নরেন্দ্র মোদী আর মোহন ভাগবতদেরচোখরাঙানিরউল্টোদিকেমানুষের প্রতিবাদ হবেই, আর সেটা কারো তৈরী করে দেওয়া,চেনা পথে নাও হতে পারে।আমাদের দেশে সংঘের মতো শক্তি ও কর্পোরেট শক্তিদের যে জোট জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার উল্টোদিকে শাসন চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই গড়ে তোলার জন্যযেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মেহনতী মানুষের রুটি-রুজির জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই, তেমনি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, নারী আন্দোলন, লিঙ্গ-যৌনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনওজাতপাতবিরোধী আন্দোলন।
দিল্লীর ১৬ই ডিসেম্বরের ঘটনার পরবর্তী আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে কলকাতার রাস্তায় মিছিল কিংবা কেরালার সাম্প্রতিক প্রতিবাদ এরকম নানাকিছুর মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতীদেরস্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ একটা নতুন প্রবণতা হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে। ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে নিমেষের মধ্যে এক জায়গার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে আর এক জায়গায়। আন্দোলনের সেই নতুন প্রবণতার শক্তি ও সীমাবদ্ধতার দিকগুলিকে ঠিকমতো বোঝা, ধৈর্য্যশীল-ক্লান্তিহীন সংগঠিত রাজনৈতিক কার্যকলাপের সাথে এই স্বতস্ফূর্তবিস্ফোরণগুলো কিভাবে পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে, সমাজের অন্ত্যজ-নিপীড়িত-মেহনতী মানুষের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের সাথে নতুন প্রজন্মের ছাত্রযুবদের একাংশের এই লড়াইয়েরআন্তঃসম্পর্ক কী হতে পারে—এই প্রশ্নগুলো প্রগতিশীল-বামপন্থী আন্দোলনের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী-যুবক-যুবতীদের এই স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভের প্রবণতাটিকে আমরা অভিনন্দন জানাই।সমাজের সদর্থক বদলে ভূমিকা পালন করতে পারেন এরকম মানুষরা প্রতিবাদের রূপের অভিঘাতে যদি আতঙ্কিত হয়ে যান, তবে ভারতে স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই গড়ে প্রশ্নে তারা যথাযথ ভুমিকা পালন করতে পারবেন না।
ক্রান্তিকারীনওজোয়ান সভার কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির পক্ষে নয়নজ্যোতি ও সুভাষিনী কর্তৃক প্রকাশিত।

Krantikari Naujawan Sabha,
Central Executive Committee Release
7th November, 2014.

No comments:

Post a Comment