Sunday, February 20, 2011

মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক

মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক

প্রাই আড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় সমাজে সামাজিক পদমর্যাদার বহুবিধ ধাপ দেখতে পাই। ধাপগুলি পিরামিডের আকারে সাজানো। সর্বোচ্চ ধাপে ব্রাহ্মণ এবং সর্বনিম্ন ধাপে অস্পৃশ্য জাতিগুলো এবং জাতি-ব্যবস্থায় না-ঢোকা আদিবাসীরা। খ্রিস্টধর্মর্ে ও ইসলামে জাতিব্যবস্থার কোনও স্থান নেই, কিন্তু তারাও ভারতে জাতি-কাঠামো অনুযায়ী বিভক্ত হয়ে পড়ে।

সামাজিক শ্রম-বিভাজনে কোন ব্যক্তি কী ভাবে অংশগ্রহণ করবেন এবং ফলে, সামাজিক উৎপন্নের কতটুকু অংশ ভোগ করবেন তা মূলত তিনি কোন ধাপে জন্ম নিয়েছেন সেটা দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক উৎপাদকদের অবস্থান পিরামিডের সর্বনিম্ন ধাপে। একটি রাজনৈতিক সূত্রীকরণের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষদের সম্পত্তির অধিকার ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। তেমনই একটি ধর্মীয় মতাদর্শগত সূত্রীকরণের মাধ্যমে দ্বিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির কোনও সচলতা থাকে না।

সমবেত। সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভা। কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১০

এই পরিস্থিতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে সমাজের উৎপাদক শ্রেণিগুলো সামাজিক উৎপন্নের বণ্টনে নিজেদের অংশ বৃদ্ধি করার জন্য সংগ্রাম করবে এবং এই সংগ্রাম সর্বদা সরাসরি শ্রেণি-সংঘাতের পথে না গিয়ে কখনও কখনও ধর্মীয় মতাদর্শগত সংগ্রামের রূপ নেবে। চার্বাক ও বুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবির, নানক ও শ্রীচৈতন্য হয়ে আধুনিক কালের জ্যোতিবা ফুলে, অম্বেডকর, শ্রীনিবাস গুরু ও পেরিয়ার পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এই সাধারণ ধারা অনুসরণ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর ধাপগুলির মধ্যে কিছু পরিমাণে অভ্যন্তরীণ শ্রেণি-বিভাজন ঘটেছে যা চলমান সংগ্রামকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে।

অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে এই ধারারই সংগ্রাম ছিল মতুয়া আন্দোলন। ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দির বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮)-এর নেতৃত্বে এক বিরাট সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। হরিচাঁদ 'হাতে কাম, মুখে নাম' এই বাণীর মাধ্যমে বলেন যে, নমঃশূদ্ররা কারও চেয়ে হীন বা নিচু নয়। কাজ করা বড় ধর্ম, শ্রমে অংশ নাও এবং গার্হস্থ্য জীবনে থাকো। কারও কাছে দীক্ষা নিও না বা তীর্থস্থানে যেও না। ঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। দলে দলে মানুষ হরিচাঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং যাঁরা তাঁর 'মত' গ্রহণ করেন তাঁরাই মতুয়া নামে পরিচিত হন।

হরিলাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭) মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ১৯১১ সালের লোকগণনায় 'চণ্ডাল' নামের বদলে 'নমঃশূদ্র' নাম ব্যবহৃত হয়। নমঃশূদ্র ছাড়াও আরও অনেক নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন, কাপালি, পৌণ্ড্র, গোয়ালা, মালো, ও মুচি মতুয়া আন্দোলনে যোগ দেন।

তাঁর পিতার নির্দেশের সঙ্গে গুরুচাঁদ যুক্ত করেন শিক্ষা বিস্তারের এবং জমিদার-বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি। এ ছাড়াও তিনি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণস্বাস্থ্যের উপর খুব নজর দেন। কোনও গ্রামের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য এলে তিনি তাদের কাছে এই শর্ত রাখতেন যে গ্রামে প্রথমে একটি স্কুল স্থাপন করতে হবে এবং মাঠে-ঘাটে মলত্যাগ না-করে বাড়িতে পায়খানা বানাতে হবে। অষ্ট্রেলীয় মিশনারি মিড সাহেবের সহায়তায় তিনি বহু স্কুল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে যে মানুষেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁর বাণী ছিল, "তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই বিদ্বান হইতে হবে পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ চিরসুখী হবে ভবে।" তাঁর সময়ে কিছু স্কুল থাকলেও তাতে অস্পৃশ্য শিশুদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তো ব্রাহ্মণ (পুরুষ) ছাড়া আর কারও ভর্তি হওয়ার অধিকার ছিল না। ১৮৮০ সালে ওড়াকান্দি গ্রামে স্কুল স্থাপিত হয়। এটি ছিল নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য নিম্নবর্ণ মানুষদের দ্বারা স্থাপিত প্রথম স্কুল।

শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া মতুয়ারা ছিলেন প্রধানত ভূমিহীন কৃষক। জমিদার ও মহাজনদের শোষণে জর্জরিত। তাই তাঁদের মধ্যে জমি সংক্রান্ত দাবি উঠে আসতে থাকে। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে নমঃশূদ্র নেতা ভীষ্মদেব দাস এবং নীরদবিহারী মল্লিক তেভাগার দাবি উত্থাপন করেন। এঁরা দু'জনেই ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। ১৯৩৩ সালে ঘাটালে সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলনে গুরুচাঁদ নিজে যোগ দেন। এবং জমিদারি উচ্ছেদ ও তেভাগার দাবি রাখেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিধানসভার ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৬টি আসন জেতে। বাকিগুলি নির্দলীয় প্রার্থীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতেন। ৩০ জনের মধ্যে ১২ জন ছিলেন নমঃশূদ্র, যাঁদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কংগ্রেসের, বাকি ১০ জন ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। বিধানসভায় রায়তদের অধিকার সংক্রান্ত বিল পাশ করানোয় এঁদের ভূমিকা ছিল। গুরুচাঁদের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে মতুয়া আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে বেশির ভাগ সংরক্ষিত আসন কংগ্রেস জিতে নেয়। তা সত্ত্বেও নমঃশূদ্র নেতা যোগেন মণ্ডলের উদ্যোগে বি আর অম্বেডকর বাংলা থেকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত হন।

দেশভাগের পর এবং বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বহু নিম্নবর্ণের মানুষ উদ্বাস্তু হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেন। তবে এখনও এঁদের বেশ বড় একটা অংশ বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অনুযায়ী তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে কমে। ২০০৩ সালে এন ডি এ পরিচালিত সরকার যে নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে তাতে উদ্বাস্তুদের বিশেষত ১৯৭১ সাল বা তার পরে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে পড়েছে। ৩০-৪০ বছর ধরে এ দেশে বসবাস করছেন এমন মানুষকেও 'বাংলাদেশি' বলে তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আর এক বার উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা তাদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। সেই অবস্থায় তাঁরা সর্বজনীন ভোটাধিকারকে ব্যবহার করে একটা রক্ষাকবচ আদায় করতে চাইছেন।

এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান। উদ্বাস্তুদের বড় অংশ বামপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বামপন্থীরা তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দেননি। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ বাংলার নিম্নবর্ণের মধ্যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, এই ভূমিকা এখনও স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর বামপন্থীরা বিলম্বিত হলেও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তৃণমূল এবং বি জে পি যারা ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়েছেন তারাও মতুয়াদের মঞ্চে হাজির। তাঁরা নাকি মতুয়াদের দাবি সমর্থন করেন। অথচ মতুয়াদের প্রধান দাবি ছিল নাগরিকত্ব আইন (২০০৩)-এর সংশোধন। রাজ্যের আবাসন দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব প্রস্তাব করলেন যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদ এক সঙ্গে দিল্লি গিয়ে মতুয়াদের দাবি পেশ করবেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কাজটা তো সেই ২০০৩ সালেই করা যেত, যখন ৪২ জন সদস্যের মধ্যে ৩৬ জনই বামফ্রন্টের ছিলেন।

ভারতে সমাজে আধুনিকতার শর্ত হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রসার। যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাতি-বর্ণ ও অন্যান্য পরিচিতি ভিত্তিক শ্রম বিভাজনের বিলোপ। শুধু আইনের বইতে নয়, বাস্তব জীবনে। এই দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য্যগুলোর সাফল্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গ এখনও অনেক পিছনে। কোনও কোনও ব্যাপারে বিহারেরও পিছনে। মতুয়া আন্দোলনের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে অবদমিত পরিচিতিগুলো সম অধিকার ও মর্যাদার জন্য সংগ্রামকে রাজনৈতিক মঞ্চে তুলে আনতে পারবেন কি না, ইতিহাসই বলবে। কিন্তু সন্দেহ নেই, পশ্চিমাঞ্চলে লাল মাটির দেশ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত আত্মপ্রতিষ্ঠার আওয়াজ মানুষকে আলোড়িত করেছে।

মতুয়া আন্দোলন যদি নাগরিকত্ব প্রশ্নে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা সমাজের গণতন্ত্রীকরণের লক্ষ্যে অন্যান্য অবদমিত জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, তা হলে তা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

previous item

editorial

next item

No comments:

Post a Comment