Sunday, September 28, 2014

বরাক উপত্যকার চিকিত্সা পরিসেবার ভয়াবহতা : একটা বাস্তব ঘটনার আলোকপাত

বরাক উপত্যকার চিকিত্সা পরিসেবার ভয়াবহতা : একটা বাস্তব ঘটনার আলোকপাত 

সন্জয় দে


---------------------------------------------------------------------------------------

৬৫ বছরের বৃদ্ধা ভোর ৫ পাঁচটায় ঘুম থেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন. 
একমাত্র ছেলে পাগলের মত ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলো -- "কি হয়েছে ? কাঁদছ কেন ?"

বৃদ্ধা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন-- আমি চউখে কুন্তা দেখিয়ার না রে " 
মানে বৃদ্ধার চোখের উপর বিশ্ব সংসার অন্ধকার হয়ে গেছে.

ডাইবেটিকের রোগী এই মহিলা তিলে তিলে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন বহুদিন আগে থেকেই. একবার অপারেশনও করিয়েছেন, কাজ হয় নি কোন. তবু কোনমতে নিজের কাজটুকু করতে পেরেছিলেন. আজ সেই আত্মনির্ভরতার মৃত্যু ঘটলো.

ছেলে বরাক উপত্যকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক চা বাগানে কাজ করে. বেসরকারী খন্ড বিশেষ করে চা বাগান কর্মীদের ছুটি পাওয়া আর ভগবান পাওয়া সমান, সাত সকালে বড় সাহেবের পায়ে হাতে ধরে এক দিনের ছুটি মঞ্জুর করে শিলচর শহরের এক মহিলা চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ কে দেখাবার ব্যবস্থা করল. ডাক্তার দেখাবার সময় বিকেল পাঁচটায়. অসুস্থ মাকে নিয়ে বিভিন্ন গাড়ি বদল করে পাঁচ ঘন্টা পথশ্রম করে শিলচর এসে পৌছল. ডাক্তার দেখিয়ে ওই রাতেই আবার বাগানে ফিরতে হবে, কারণ কালকের ছুটি নেই, আর শিলচর শহরে রাত্রিবাস করার মত কোন আত্মীয়-স্বজন নেই.

বৃদ্ধা ডাক্তারের হাতে ধরে কেঁদে বলল- আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও গো মা, আমি তোমার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছি.

ডাক্তার রোগীকে রোগীকে ভালো ভাবে পরীক্ষা করলেন. তারপর ছেলেকে বললেন- আপনাকে কাল উনাকে নিয়ে মেডিকেল কলেজে আসতে হবে সকাল ১০ টার মধ্যে. কারণ আমার এখানে চোখ পরীক্ষার সব যন্ত্র নেই. মেডিকেলে অন্য যন্ত্র দিয়ে উনার চোখ পরীক্ষা করতে হবে. আর শুনুন পেশেন্ট যেন কিছু না খেয়ে আসে. কারণ মেডিকালে ব্লাড টেস্ট করাতে হবে. ডাক্তারকে ৩০০ টাকা ফিস দিয়ে মাকে নিয়ে ছেলে যখন চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল তখন সন্ধ্যা ৬ টা. চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে. . অন্ধ মাকে ধরে ধরে পুজোর ভিড় বহুল শহর অতিক্রম করে বাস স্ট্যান্ডে এসে শেষ গাড়িটা ধরতে পারলো.

এখানে প্রশ্ন হলো.-- যে ডাক্তারের কাছে রোগীর চক্ষু পরীক্ষার মত পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি থাকে না, সে কেন চেম্বার খুলে বসে কিছু না করেই রোগীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা ফিস নেবে ? সেই ডাক্তার তো চেম্বারে না বসে সরাসরি মেডিকেলেই সব রোগী দেখতে পারে. একজন ডাক্তারের কাছে ব্যবসা যখন সেবা থেকে প্রাধান্য পেয়ে যায়, তখনই রোগীর শিয়রে যমরাজ এসে বসে যান.

এখন শুনুন মেডিকেলের বিবরণ.

বাগানের বড় সাহেবের কাছে থেকে বকুনি খেয়ে মাকে নিয়ে সকাল দশটার মধ্যে এসে পৌছল শিলচরের মেডিকাল কলেজে. ডাক্তারের সাথে দেখা করতেই তিনি বললেন. আপনি কার্ড করিয়ে নিয়ে আসুন কাউন্টার থেকে. পাঁচ টাকা লাগবে. কার্ড করতে গিয়ে দেখলো মস্ত লম্বা লাইন. তবু লাইনে দাড়িয়ে কার্ড করলো. কার্ড নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই তিনি বললেন, আপনি ওই কাউন্টারে গিয়ে কার্ডটা রেজিস্টার্ড করিয়ে নিয়ে আসুন, আর কার্ড নিয়ে ওই ডাক্তারবাবুর কাছে চলে আসবেন, প্রথমে উনি আপনার মাকে দেখবে, তারপর আমি দেখব.

কার্ড রেজিষ্ট্রশন করাতে গিয়ে আবার সেই লম্বা লাইন. শুধুমাত্র কার্ডের পাল্লায় পড়ে কিন্তু এক ঘন্টা already চলে গেছে. অসুস্থ মা সেই সকাল থেকে খালি পেটে বসে আছে বেলা ১১ টা পর্য্যন্ত.

তারপর দু ডাক্তার মিলে বৃদ্ধার চোখ দেখলো. তারপর বলল- শুনুন, আমি লিখে দিচ্ছি আপনি উনার ব্লাডটা পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসুন. প্রথমে কাশ কাউন্টার- এ টাকা জমা করবেন তার পর এই ক্যাশ মেমো নিয়ে ব্লাড দিতে কাউন্টার-এ চলে যাবেন.

কাশ কাউন্টার-এর দৃশ্য টা কি জানেন ? মোট ৪ টা কাউন্টার আছে কিন্তু কাজ হচ্ছে মাত্র একটা কাউন্টার-এ, বাকি তিনটা কাউন্টার-এ কেউ নেই. বাইরে ১০০/১৫০ মানুষের ভিড় আর টাকা জমা নিচ্ছে মাত্র একজন. যাই হোক, দেড় ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে টাকা তো জমা দেওয়া হলো. বেলা তখন সাড়ে বারোটা ক্ষুধায় অসুস্থ বৃদ্ধা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লো. এর মধ্যে চোখে দৃষ্টি নেই. মাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল আরেকটা কাউন্টার-এ, যেখানে ব্লাড টেস্টের জন্য স্টিরিলায়জ বোতল দেওয়া হবে. সেখানে প্রায় ৩০/৩৫ জন মানুষের লাইন, তারপর ব্লাড দিতে গিয়ে ৫০ জন মানুষের লাইন. যাই হোক সব লাইন অতিক্রম করে বেলা ৩ টায় গিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে উপস্থিত হলো. ডাক্তার বললেন -আপনি পেশেন্টকে ওই বেঞ্চিতে বসিয়ে রেখে আপনি আমার কাছে আসুন.

অসুস্থ, ক্ষুধার্ত আর অন্ধ মাকে বেঞ্চিতে বসিয়ে সে এলো ডাক্তারের কাছে. ডাক্তার মুখ বেজার করে বললেন-- আপনার মা'র এখানে কোন চিকিতসা হবে না, মাকে নিয়ে আপনাকে গুহাটি শঙ্করদেব নেত্রালয়ে যেতে হবে. আপনার মা'র চোখে রক্ত জমে গেছে. চোখ থেকে ওই ব্লাড ওয়াশ করতে হবে. আমাদের এখানে এই ব্যবস্থা নেই, তাই আপনাকে গৌহাটি যেতে হবে পেশেন্ট নিয়ে.

বরাক উপত্যকা থেকে কোনো রোগী নিয়ে গৌহাটি যাবার বিড়ম্বনার কথা লিখে পাঠকের আর বিরক্তি উতপাদন করলাম না আমার মনে হয় সেটা বর্ণনা থেকে কল্পনা করাই সহজ হবে বেশি.

আমার বক্তব্য হলো---
১) চোখ পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সামগ্রী না নিয়ে একটা ডাক্তার কেন চেম্বার খুলে বসে রোগীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা আদায় করবে ফিস হিসেবে ? এসব দেখার কি কেউ নেই ?

২) এই যে বাগান কর্মীটি ২ টা কর্মহীন দিন অতিক্রান্ত করলো, এতটা ব্যয় বহন করলো, পথশ্রমের কষ্ট সহ্য করলো আর অসুস্থ মা আরো অসুস্থ হলো, তার জন্য দায়ী কে ? আর লাভটা কি হলো ? দেড় দু হাজার টাকা জলে বিসর্জন দিয়ে সে ডাক্তারের মুখ থেকে কি শুনল, মা'র জন্য কি চিকিত্সা পেল ? "আপনার মাকে নিয়ে গৌহাটি শঙ্করদেব নেত্রালয়ে যেতে হবে "--এটা কি পয়সা খরচ না করে শুনা যেত না ?

৩) গৌহাটি শঙ্করদেব নেত্রালয়ে যে সুবিধা আছে, তা কেন শিলচর মেডিকেল কলেজে থাকবে না ? চিকিত্সা খাতে তো কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে.

৪) বরাক উপত্যকার কতজন রোগীর আর্থিক ক্ষমতা আছে গৌহাটি শঙ্করদেব নেত্রালয়ে গিয়ে চিকিতসা করবার ?

৫) তাহলে যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তারা কি চোখের রোগ হলে অন্ধত্বকে বরণ করে নেবে, মেডিকেলে চক্ষু পরীক্ষার ভাল যন্ত্রপাতি নেই বলে ?

সহস্র প্রতিকুলতার অভিঘাত বরাক উপত্যকার মানুষ এমনিতেই সহ্য করছে প্রতিদিন, তার উপর চিকিতসা ক্ষেত্রে যদি এই দানবীয়তা অব্যাহত থাকে, তাহলে এরা যাবে কোথায় ?


No comments:

Post a Comment